ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ , ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​পীরের আস্তানায় নবান্ন উৎসব

৯২ মণ গুড় আর ১০৫ মণ চাল দিয়ে তৈরি ক্ষীর

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২২-১১-২০২৪ ০৬:২৩:৩২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২২-১১-২০২৪ ০৬:২৩:৩২ অপরাহ্ন
৯২ মণ গুড় আর ১০৫ মণ চাল দিয়ে তৈরি ক্ষীর ​সংবাদচিত্র : সংগৃহীত
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামে চিশতীয়া পীরের আস্তানায় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব উদযাপন উপলক্ষে একদিনের জমজমাট নবান্ন মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতি বছর বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার এই উৎসব উদযাপন করা হয়।  
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সকাল থেকে রাত ২টা পর্যন্ত চলে উৎসবের নানা কার্যক্রম। হাজার হাজার ভক্ত, মুরিদ ও দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে পুরো এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এটি বাংলার সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক চেতনার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিশাল পরিসরে ক্ষীর রান্না। আস্তানার ভাণ্ডার খানা থেকে জানা যায়, এবছর ক্ষীর তৈরিতে ১০৫ মণ চাল, ৯২ মণ গুড়, ৬৬ মণ দুধ এবং ৫০০টি নারিকেল ব্যবহার করা হয়েছে। রান্নার জন্য ২৫০টি চুলা স্থাপন করা হয়।
ক্ষীর রান্নায় প্রায় ৬০০ পীরভক্ত এবং ৩৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। রান্নার কাজ শেষ হওয়ার পর জিকিরের মাহফিল শুরু হয়। মাহফিল শেষে হাজার হাজার ভক্তদের মধ্যে ক্ষীর বিতরণ করা হয়।
আস্তানার ভাষ্যমতে, হযরত খাজা শাহ মাওলানা মো. আব্দুল গফুর চিশতী ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামে আসেন। তার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তব, চশমায়ে উলুম মাদ্রাসা এবং একটি আস্তানা। তিনি ১৩৮২ সালের ১৬ শ্রাবণ ইন্তেকাল করেন। তার অনুসারীরা প্রতি বছর এই নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ নারিকেল ভাঙছেন, কেউ গুড় গলাচ্ছেন, আবার কেউ ক্ষীর রান্নায় ব্যস্ত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ উৎসবে অংশ নিতে আসেন।
উৎসবকে ঘিরে পুরো বেগুনগ্রামে বসে একদিনের জমজমাট মেলা। রাস্তার দুই পাশে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দোকান বসে। মেলায় কাঠের খেলনা, মাটির ব্যাংক, হাতপাখা, পিরা, হাড়ি-পাতিলসহ নানা পণ্য বিক্রি হয়। ঐতিহ্যবাহী নাগরদোলা ও চরকি উৎসবের মেলায় বাড়তি আকর্ষণ যোগ করে। গ্রামের প্রতিটি ঘর যেন উৎসবের অংশ হয়ে ওঠে। রান্না হয় মাংস, পায়েস এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবার। রান্নার কাজ শেষে শুরু হয় জিকিরের মাহফিল, যা পুরো এলাকায় আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করে। মাহফিল শেষে ক্ষীর বিতরণ করা হয়, যা মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যের এক বিরল উদাহরণ হয়ে ওঠে।
কুমিল্লার কাশিমপুর থেকে আগত আইনুল হোসেন বলেন, “নবান্ন উৎসব কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিলনমেলা। এই আয়োজন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।”
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিনহাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই নবান্ন উৎসব শত বছরের কাছাকাছি পুরনো। প্রতিবছর এখানে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এটি আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধারণ করে ঐতিহ্য রক্ষা করছে।
আস্তানার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুল ইসলাম জানান, আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি, পীর সাহেবের আগমনের তিন বছরের মধ্যেই এই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। সেই ঐতিহ্য আজও অব্যাহত রয়েছে।
চিশতীয়া পীরের আস্তানার সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন মণ্ডল বলেন, এই আস্তানা ১৩৭২ সালের ৬ কার্তিক উদ্বোধন করা হয়। এটি বর্তমানে ৩৭ শতক জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই আস্তানার সব কার্যক্রম ভক্তদের অনুদানের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। চিশতীয়া পীরের আস্তানার নবান্ন উৎসব কেবল একটি গ্রামীণ মেলা নয়, এটি বাংলার আধ্যাত্মিকতা ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

বাংলা স্কুপ/ প্রতিনিধি/ এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ